বাঙালির প্রাণের ‘মহানায়ক’ তিনি। মৃত্যুর চার দশক পরেও সামনভাবে বাঙালির কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর চোখের চাহনি, অমলিন হাসি আর নায়ক সুলভ চেহারা কত নারী হৃদয়েই না ঢেউ তুলেছে! অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের উত্তম কুমার হয়ে উঠবার কাহিনিটা কোনও রূপকথার চেয়ে কম নেই। তেমনই মহানায়কের প্রেম-জীবনও সামন আকর্ষণীয় বাঙালির কাছে। পর্দায় উত্তম-সুচিত্রা জুটি ইতিহাস লিখেছিল, তবে বিবাহিত উত্তমের জীবনের স্ত্রী গৌরী দেবী ব্যতীত যে নারীর নাম সবচেয়ে চর্চায় থেকেছে তা নিঃসন্দেহে সুপ্রিয়া দেবী।
সুপ্রিয়া দেবী তাঁর স্মৃতিকথা ‘আমার জীবন আমার উত্তম’-এ উল্লেক করেছিলেন ১৯৬২ সালের ২রা ডিসেম্বর ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি মেনে বিয়ের বাঁধনে বাঁধা পড়েছিলেন তাঁরা। যদিও গৌরী দেবীর সঙ্গে আইনত বিবাহবিচ্ছেদ না হওয়ায় সেই বিয়ের মান্যতা ছিল না।
সুপ্রিয়ার সঙ্গে প্রেম ও সংসার করা নিয়ে প্রিয়জনদের প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছিল উত্তম কুমারকে কিন্তু তিনি পিছু হটেননি। উত্তম কুমারের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুরকার শ্যামল মিত্রের পুত্র সৈকত মিত্র এক সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, ‘দেয়া নেয়া’ ছবির শ্যুটিং বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, ছবির প্রযোজক শ্যামল মিত্র। বলেছিলেন উত্তম-কে ফিরতে হবে গৌরী দেবীর কাছে। উত্তম কুমার ও শ্যামল মিত্রর বন্ধুত্বের কথা কারুর অজানা নয়। বন্ধুর দাম্পত্য জীবনে নেমে আসা ঝড় সামলাতেই একথা বলেছিলেন শ্যামল মিত্র। সৈকত জানিয়েছেন, ‘দেয়া নেয়া’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময়ই ভাবনীপুরের বাড়ি ছেড়ে ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়া দেবীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিলেন উত্তম কুমার।

সেই কথা শ্যামল মিত্রর কানে পৌঁছাতেই তিনি উত্তম কুমারকে ডেকে বলেন, ‘ভবানীপুরে ফিরে না গেলে ছবির শ্যুট বন্ধ।' সেইমতো শ্যুটিং বন্ধ হয়ে যায় দেয়া নেয়া'র। উত্তমের পাশে গৌরী দেবীকে দেখতে অভ্যস্ত শ্যামল মিত্র মেনে নিতে পারেননি সুপ্রিয়া দেবীকে। যদিও বন্ধুত্বে আশ্বস্ত করে উত্তম কুমার জানিয়েছেন, ‘এখনই বেণুকে ছেড়ে যেতে পারব না, একটু সময় দে আমায়’।

না, এরপর আর কোনওদিনই বেণু-কে (সুপ্রিয়া দেবীকে এই নামেই ডাকতেন উত্তম কুমার) ছেড়ে যেতে পারেননি উত্তম কুমার। শেষমেষ নিজের শর্ত ফিরিয়ে নিয়েছিলেন শ্যামল মিত্র। আসলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সুপ্রিয়া দেবীর প্রতি উত্তমের টান ক্ষণস্থায়ী নয়, এটা চিরকালীন প্রেম।
এক মাস পরে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাওয়ার পর নতুন করে শ্যুটিং শুরু হয় দেয়া নেয়া-র। সৈকতের কথায়, ‘আমার বাবা-ই বোধহয় মহানায়ককে এই নির্দেশ দিতে পেরেছিলেন'। পেশাদার সম্পর্কের বাইরেও উত্তম কুমার ও শ্যামল মিত্রের মধ্যে যে অধিকারবোধের সম্পর্ক ছিল তার জেরেই এই নির্দেশ।