যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রটি কলকাতার উপকণ্ঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত৷ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুরের সমাজ জীবনে বামপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী উভয় রাজনীতির প্রভাব বরাবরই বিভিন্ন মাত্রায় লক্ষ্য করা গিয়েছে। ঐতিহাসিকভাবেই এই কেন্দ্রটির এক আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৭৭ সালে এই কেন্দ্রটি আত্মপ্রকাশ ঘটে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তথ্য অনুযায়ী এই কেন্দ্রের মোট ভোটদাতা ছিল ১৫ লক্ষ ৯৫ হাজার ৭৪৬ জন। বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, সোনারপুর, দক্ষিণ ভাঙ্গর, যাদবপুর, সোনারপুর উত্তর এবং টালিগঞ্জ এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রটি গঠিত। ঐতিহাসিকভাবে যদি দেখা যায় ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্র থেকে সিপিআইএমের প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় জয়ী হন। ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনেও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মমতা ব্যানার্জি এই কেন্দ্রে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে জয়ী হন। তবে ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে ফের সিপিআইএমের প্রার্থী মালিনী ভট্টাচার্য এই কেন্দ্রটি জাতীয় কংগ্রেসের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন।
এবার এই গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র থেকে তিন প্রধান দল তিনজন নতুন প্রার্থীকে নামিয়েছে। তৃণমূলের টিকিট পেয়েছেন অভিনেত্রী তথা দলের তরুণ মুখ সায়নী ঘোষ। প্রচারে রীতিমত সাড়া ফেলেছেন তিনি। যেকয়েকজন হাতে গোনা নেতার হাত ধরে সিপিএম ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে, তার মধ্যে অন্যতম হল সৃজন ভট্টাচার্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভোট হলে সৃজনের জয় পাকা ছিল, কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সংগঠনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সিপিএম কতটা ভোটের দিন দাগ কাটতে পারে সেটাই দেখার। আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট হলে নিশ্চিত ভাবেই বামেরা খুব ভালো জায়গায় থাকত এই আসনে। আইএসএফ-এর পক্ষ থেকে নুর আলম খান এখানে লড়াই করছেন। বিজেপির হয়ে টিকিট পেয়েছেন বুদ্ধিজীবী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়। তবে তাঁর জনভিত্তি বা ক্যাডারদের সঙ্গে মিশে গিয়ে লড়ার কতটা ক্ষমতা আছে, সেটা নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে। পয়লা জুন সপ্তম দফায় যাদবপুরে ভোট হবে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে মালিনী ভট্টাচার্য এই কেন্দ্রে সাংসদ নির্বাচিত হন। এর পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে কৃষ্ণা বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণা বসু এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে ২০০৪ সালে সুজন চক্রবর্তী সিপিআইএমের প্রার্থী হিসেবে এই কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে সুজন চক্রবর্তীকে হারিয়ে কবীর সুমন এই কেন্দ্রে তৃণমূলকে জয়যুক্ত করেন। এরপর তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের ধারা অব্যাহত থাকে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে। ২০১৪ সালে সুগত বসু এই কেন্দ্রটি থেকে জয়ী হন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুজন চক্রবর্তীকে ৯.৮৪ শতাংশ ভোটের মার্জিনে হারিয়ে। এই নির্বাচনেই দেখা যায় তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার সামান্য কমার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপির ভোটের হার ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সিপিআইএমের ভোটের হার আরও কমে যায়। দীর্ঘদিন ধরে বামেদের শক্ত ঘাঁটি এই কেন্দ্রটিতে বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য ৩ লক্ষ ২২৬৪ টি ভোট পান। যেখানে বিজেপির পক্ষ থেকে অনুপম হাজরা ৩ লক্ষ ৯৩ হাজারের অধিক ভোট পায়। সিপিআইএম এবং বিজেপিকে পরাজিত করে এই কেন্দ্র থেকে শেষ হাসি হাসে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী। তিনি মোট ভোটারের ৪৭.৯১ শতাংশের জনসমর্থন পান।
এবার আমরা একনজরে দেখে নেব, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ভিত্তিতে এই কেন্দ্র থেকে কারা কত ভোটে এগিয়ে ছিল। বারুইপুর পূর্ব এবং বারুইপুর পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রটিতে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে যথাক্রমে বিভাস সর্দার এবং বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ী হন। সোনারপুর দক্ষিণ কেন্দ্রে লাভলী মৈত্র তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ২১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে পরাজিত করেন। যাদবপুর, সোনারপুর উত্তর এবং টালিগঞ্জ কেন্দ্র তিনটিতে যথাক্রমে দেবব্রত মজুমদার, ফিরদৌসী বেগম এবং অরূপ বিশ্বাস সাংসদ নির্বাচিত হন।